বাংলাদেশের অর্থনীতি: উন্নয়নের গতিপথ, চ্যালেঞ্জ ও অন্তরায়


🇧🇩বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির একটি। গত কয়েক দশকে এটি দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সূচকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। তবে এই গতি বজায় রাখতে হলে কিছু মৌলিক অন্তরায় বা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা অপরিহার্য।

​📈 অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি ও সাফল্যের ভিত্তি (Key Drivers and Successes)

​বাংলাদেশের অর্থনীতির এই উল্লম্ফন মূলত চারটি শক্তিশালী স্তম্ভের উপর নির্ভর করে:

​১. তৈরি পোশাক শিল্প (Readymade Garments - RMG)

  • অবদান: এটি দেশের বৃহত্তম রপ্তানিমুখী খাত, যা মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৪% জোগান দেয়।
  • কর্মসংস্থান: এই খাত প্রায় ৪.৫ মিলিয়ন (৪৫ লাখ) শ্রমিকের কর্মসংস্থান তৈরি করেছে, যা গ্রামীণ অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়িয়েছে।
  • সাফল্য: বাংলাদেশ চীন ও ভিয়েতনামের পর বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ পোশাক রপ্তানিকারক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

​২. প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স (Remittances)

  • ​বিদেশে কর্মরত ১.৩ কোটিরও বেশি প্রবাসীর পাঠানো রেমিট্যান্স বৈদেশিক মুদ্রার অন্যতম প্রধান উৎস
  • ​এটি গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে এবং সরাসরি দারিদ্র্য বিমোচনে ভূমিকা রাখে। কোভিড-১৯ মহামারীর সময়েও রেমিট্যান্স প্রবাহ ছিল স্থিতিশীল।

​৩. কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা (Agriculture and Food Security)

  • উত্পাদনশীলতা: কৃষিতে উচ্চ ফলনশীল জাতের উদ্ভাবন ও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে বাংলাদেশ ধান, মাছ, ও সবজি উৎপাদনে বিশ্বে শীর্ষস্থানীয় অবস্থানে রয়েছে।
  • ​এর ফলে বিশাল জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছে।

​৪. দেশীয় ভোগ ও সেবা খাত (Domestic Consumption and Service Sector)

  • জনসংখ্যাগত লভ্যাংশ (Demographic Dividend): বিশাল কর্মক্ষম তরুণ জনসংখ্যা এবং মানুষের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির কারণে অভ্যন্তরীণ ভোগ বা চাহিদা দ্রুত বেড়েছে।
  • ​জিডিপি-তে সবচেয়ে বড় অবদান এখন সেবা খাতের (ব্যাংকিং, টেলিকম, পরিবহন ইত্যাদি)।

​উন্নয়নের প্রধান অন্তরায় ও চ্যালেঞ্জসমূহ (Major Obstacles to Development)

​বাংলাদেশের অর্থনীতির টেকসই প্রবৃদ্ধি বজায় রাখার পথে কিছু গুরুতর কাঠামোগত দুর্বলতা ও চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান:

​১. দুর্বল অবকাঠামো ও লজিস্টিকস (Weak Infrastructure and Logistics)

  • বিদ্যুৎ ও জ্বালানি: যদিও বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে, সরবরাহ ব্যবস্থা, বিতরণে ঘাটতি এবং জ্বালানি তেলের বৈশ্বিক অস্থিরতা এখনও বড় চ্যালেঞ্জ।
  • পরিবহন ব্যবস্থা: দুর্বল সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থাপনা, বন্দরগুলোর সক্ষমতার অভাব এবং যানজট পণ্য পরিবহন খরচ (Logistics Cost) বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়, যা রপ্তানিকারকদের জন্য প্রতিযোগিতা কঠিন করে তোলে।

​২. সুশাসন ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা (Governance and Institutional Weakness)

  • দুর্নীতি: দুর্নীতি অর্থনীতির অন্যতম প্রধান অন্তরায়। এটি বিনিয়োগের পরিবেশ নষ্ট করে, সরকারি প্রকল্পের ব্যয় ও সময় বাড়িয়ে দেয় এবং সম্পদ বিতরণে বৈষম্য তৈরি করে।
  • আমলাতান্ত্রিক জটিলতা: ব্যবসা শুরু করা বা পরিচালনা করার ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রিতা ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করে।
  • আইন প্রয়োগ: চুক্তির দুর্বল প্রয়োগ ও বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রিতা বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমিয়ে দেয়।

​৩. সীমিত রপ্তানি বহুমুখীকরণ (Limited Export Diversification)

  • অত্যধিক নির্ভরশীলতা: অর্থনীতি এখনও প্রধানত তৈরি পোশাক খাতের উপর অত্যধিক নির্ভরশীল।
  • ঝুঁকি: কোনো কারণে পোশাক খাতে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটলে পুরো অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার ঝুঁকি থাকে।
  • ​পোশাকের বাইরে আইটি/আইটিইএস, ঔষধ শিল্প, চামড়াজাত পণ্য, এবং হালকা প্রকৌশল খাতের সম্ভাবনা কাজে লাগানো জরুরি।

​৪. আর্থিক খাতের দুর্বলতা (Financial Sector Fragility)

  • খেলাপী ঋণ: ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের উচ্চ হার একটি গুরুতর সমস্যা। এটি ব্যাংকের তারল্য (Liquidity) কমিয়ে দেয় এবং ঋণ প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে।
  • পুঁজিবাজার: দেশের পুঁজিবাজার এখনও অস্থিতিশীল এবং দুর্বল নিয়ন্ত্রণের কারণে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ধরে রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে।

​৫. মানবসম্পদের গুণগত মান (Quality of Human Capital)

  • ​দেশের কর্মক্ষম জনসংখ্যা বিশাল হলেও, মানসম্মত শিক্ষা ও কারিগরি প্রশিক্ষণের অভাবে তাদের দক্ষতা আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদা মেটাতে পারছে না
  • ​ফলস্বরূপ, উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন পদের জন্য প্রায়শই বিদেশি কর্মীদের উপর নির্ভর করতে হয়।

​ভবিষ্যতের সম্ভাবনা ও লক্ষ্য (Future Prospects and Goals)

  • LDC গ্র্যাজুয়েশন (২০২৬): স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণের পর আন্তর্জাতিক বাজারে কিছু শুল্ক সুবিধা হারাবে বাংলাদেশ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় রপ্তানি প্রতিযোগিতা বাড়াতে হবে।
  • উন্নত দেশ (২০৪১): বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যে একটি জ্ঞানভিত্তিক, উচ্চ আয়ের উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।
  • ​এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক বৈচিত্র্য আনা এবং সুশাসন নিশ্চিত করা আবশ্যক।

​এই অন্তরায়গুলো দূর করতে পারলে বাংলাদেশের অর্থনীতি আরও স্থিতিশীল ও টেকসই প্রবৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে পারবে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ