আদম (আঃ) থেকে আধুনিক যুগ: ইসলামের ইতিহাসের পূর্ণাঙ্গ সংকলন (উৎসসহ)

ইসলামী বিশ্বাস অনুসারে, ইতিহাস কেবল মানুষের কর্মকাণ্ডেরই নয়, বরং আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে মানবজাতির জন্য প্রেরিত নবুয়ত ও হেদায়েতের ধারাবাহিকতার গল্প। এই বিশাল পথপরিক্রমা শুরু হয়েছে মানবজাতির আদি পিতা হযরত আদম (আঃ) থেকেই।

১. নবুয়তের আদি যুগ: মানবজাতির সূচনা ও মৌলিক শিক্ষা

এই যুগ শুরু হয় হযরত আদম (আঃ)-এর পৃথিবীতে আগমনের মাধ্যমে এবং তা হযরত ঈসা (আঃ)-এর মাধ্যমে সমাপ্ত হয়। এই সময়ে প্রেরিত সকল নবীর মূল শিক্ষা ছিল একত্ববাদ (তাওহীদ)
পর্যায়প্রধান নবী/ব্যক্তিত্বমূল ঘটনা ও শিক্ষানির্ভরযোগ্য উৎস
আদম ও বসতি স্থাপনহযরত আদম (আঃ)জান্নাত থেকে পৃথিবীতে আগমন; প্রথম মানব ও প্রথম নবী। আল্লাহ্‌র কাছে আত্মসমর্পণের (ইসলাম) মৌলিক শিক্ষা।কুরআন (সূরা বাকারা: ৩০-৩৯), সহীহ মুসলিম (মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সৃষ্টির বর্ণনা)।
মহাপ্লাবনহযরত নূহ (আঃ)আল্লাহ্‌র আদেশে কিস্তি নির্মাণ ও মহাপ্লাবন; মূর্তিপূজা থেকে একত্ববাদের পুনর্জাগরণ।কুরআন (সূরা নূহ, সূরা হূদ: ২৫-৪৯)।
মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহিম (আঃ)মক্কার কাবা ঘরের ভিত্তি পুনর্নির্মাণ; তাওহীদের শিক্ষা। তার বংশধরদের মাধ্যমেই পরবর্তী প্রায় সকল নবী প্রেরিত হন।কুরআন (সূরা বাকারা: ১২৫-১২৭), সহীহ বুখারী (নবীগণের কাহিনী অধ্যায়)।
বনী ইসরাঈলহযরত মুসা (আঃ)ফেরাউনের কবল থেকে মুক্তি; সিনাই পর্বতে তাওরাত লাভ এবং বিস্তারিত শরীয়ত প্রবর্তন।কুরআন (সূরা কাসাস, সূরা ত্বাহা), সহীহ বুখারী (নবীগণের কাহিনী অধ্যায়)।
আল্লাহর কুদরতে পিতাবীহীন সন্তান হযরত ঈসা (আঃ)বনী ইসরাঈলের প্রতি প্রেরিত; ইনজিল লাভ; তাওহীদের বার্তা পুনরুজ্জীবন।কুরআন (সূরা আল-ইমরান: ৪৫-৫১, সূরা মারিয়াম)।

২. নবুয়তের সমাপ্তি ও ইসলামী সাম্রাজ্যের উত্থান (৫৭০ খ্রি. – ৬৬১ খ্রি.)

এটি হলো ইতিহাসের সেই চূড়ান্ত পর্ব, যেখানে ইসলাম তার পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করে এবং রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

পর্যায়প্রধান ঘটনা/তথ্যনির্ভরযোগ্য উৎস
চূড়ান্ত বার্তা (৬১০ খ্রি.)হেরা গুহায় কুরআন-এর প্রথম ওহী লাভ; ইসলামের শাশ্বত জীবন বিধান চূড়ান্ত রূপ লাভ করে।কুরআন (সূরা আলাক: ১-৫), সহীহ বুখারী (ওহীর সূচনা অধ্যায়)।
হিজরত ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা (৬২২ খ্রি.)মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের মাধ্যমে প্রথম মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা।আল-সিরাহ আল-নাবাবিয়াহ (ইবনে হিশাম), সহীহ বুখারী
খোলাফায়ে রাশেদীনচারজন ন্যায়পরায়ণ খলিফার মাধ্যমে শাসন। সাম্রাজ্য সিরিয়া, মিশর, পারস্য সহ বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের বড় অংশ বিজয় করে।তারিখ আল-তাবারি, আল-কামিল ফিত-তারিখ (ইবনুল আসির), সহীহ মুসলিম (খিলাফত সংক্রান্ত হাদীস)।



৩. মধ্যযুগীয় খিলাফত ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের স্বর্ণযুগ (৬৬১ খ্রি. – ১২৫৮ খ্রি.)

পর্যায়প্রধান ঘটনা/তথ্যনির্ভরযোগ্য উৎস
উমাইয়া খিলাফতদামেস্ক রাজধানী; ইসলামের ইতিহাসে সর্বাধিক ভৌগোলিক বিস্তার (স্পেন থেকে মধ্য এশিয়া)।তারিখ আল-খুলাফা (জালালুদ্দিন সুয়ুতি), তারিখ আল-ইয়াকুবি
আব্বাসীয় খিলাফত (স্বর্ণযুগ)বাগদাদ রাজধানী; জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সভ্যতার কেন্দ্র। 'বায়তুল হিকমাহ' প্রতিষ্ঠা; দর্শন, গণিত ও চিকিৎসাবিজ্ঞানে যুগান্তকারী আবিষ্কার।আল-মুকাদ্দিমা (ইবনে খালদুন), কিতাব আল-ফিহরিসত (ইবন আল-নাদিম)।
বাগদাদের পতন (১২৫৮ খ্রি.)মঙ্গোল নেতা হালাকু খানের হাতে বাগদাদের ধ্বংস এবং আব্বাসীয় খিলাফতের পতন।জামিউত তাওয়ারীখ (রশিদ আল-দীন)।

৪. তিনটি বৃহৎ সাম্রাজ্য ও ঔপনিবেশিক যুগ (১২৫৮ খ্রি. – ১৯২৪ খ্রি.)

সাম্রাজ্য/যুগপ্রধান ঘটনা/তথ্যনির্ভরযোগ্য উৎস
উসমানীয় সাম্রাজ্য১৯২৪ সাল পর্যন্ত খিলাফত ধরে রেখেছিল। তুরস্ক, মধ্যপ্রাচ্য ও বলকান অঞ্চলের শাসন।A History of the Ottoman Empire (কার্ডিনাল বাউডিন), বিভিন্ন অটোমান আর্কাইভ।
মুঘল সাম্রাজ্যভারতীয় উপমহাদেশে শাসন; তাজমহলের মতো স্থাপত্যের নির্মাণ।আকবরনামা (আবুল ফজল), তুযুক-ই-বাবুরি (বাবর)।
সাফাভিদ সাম্রাজ্যপারস্যে শিয়া ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠা।আলম আরায়ে আব্বাসি (এস্কান্দার বেগ মুনশি)।
ঔপনিবেশিকতা১৮শ ও ১৯শ শতাব্দীতে পশ্চিমা শক্তিগুলোর দ্বারা মুসলিম বিশ্বের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা।Orientalism (এডওয়ার্ড সাইদ), সমসাময়িক ঔপনিবেশিক আর্কাইভ।

৫. আধুনিক যুগ ও বর্তমান অবস্থা (১৯২৪ খ্রি. – আজ পর্যন্ত)

পর্যায়প্রধান ঘটনা/তথ্যনির্ভরযোগ্য উৎস
খিলাফতের অবসান (১৯২৪)কামাল আতাতুর্কের মাধ্যমে উসমানীয় খিলাফতের বিলুপ্তি।The Ottoman Caliphate and Its Survival (ইলিয়ট কুলিক), সমসাময়িক সরকারি ডিক্রি।
আধুনিক রাষ্ট্র গঠনমুসলিম দেশগুলোর স্বাধীনতা লাভ ও জাতীয়তাবাদী ধারার ভিত্তিতে আধুনিক রাষ্ট্র গঠন।সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর স্বাধীনতা সনদ, জাতিসংঘ এবং সমসাময়িক রাজনৈতিক বিশ্লেষণ।
বর্তমান চ্যালেঞ্জঅর্থনৈতিক বৈষম্য, গণতান্ত্রিক সংস্কার, পশ্চিমা প্রভাব, অভ্যন্তরীণ সংঘাত এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ ও আধুনিকতার মধ্যে সমন্বয়ের মতো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা।জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক, এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গবেষণামূলক জার্নাল ও বিশ্লেষণ।

এই বিশাল ইতিহাস প্রমাণ করে যে ইসলাম একটি সত্য ও ন্যায়ের ধর্ম এবং এটি যুগে যুগে মানবজাতির সামাজিক, রাজনৈতিক ও জ্ঞানভিত্তিক অগ্রগতি ও কল্যাণ করেছে। এটি মানব জাতির শান্তির ধর্ম। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ