ইতিহাস: প্রাচীনকাল থেকে ২০২৪ গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ বিবরণ


বর্তমান বাংলাদেশ একটি স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র, যার জন্ম হয়েছে চার সহস্রাব্দের পুরনো সমৃদ্ধ সভ্যতা, শত শত বছরের শাসন পরিবর্তন এবং এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে।


১. প্রাচীন যুগ: জনপদ ও সাম্রাজ্য (খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ অব্দ – ১২০০ খ্রিস্টাব্দ)

প্রাচীন বাংলায় আর্য-পূর্ব নিষাদ, দ্রাবিড় এবং মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠী বসবাস করত। এই অঞ্চল বহু স্বাধীন জনপদে বিভক্ত ছিল।

  • প্রাচীন জনপদ: সবচেয়ে প্রাচীন জনপদ ছিল পুণ্ড্র (বৃহত্তর বগুড়া, রাজশাহী, রংপুর অঞ্চল), যার রাজধানী ছিল পুণ্ড্রবর্ধন (মহাস্থানগড়)। এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ জনপদ ছিল বঙ্গ (বৃহত্তর ঢাকা, ফরিদপুর), গৌড় (রাজা শশাঙ্কের রাজধানী), সমতট (কুমিল্লা-নোয়াখালী) এবং হরিকেল (চট্টগ্রাম)।

  • বৌদ্ধ ও হিন্দু সাম্রাজ্য: খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতকে বাংলার অংশবিশেষ মৌর্য ও গুপ্ত সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। অষ্টম শতকে পাল সাম্রাজ্য (৭৫০-১১৫০ খ্রি.) প্রতিষ্ঠিত হয়, যা ছিল শিল্পকলা ও শিক্ষাদীক্ষার স্বর্ণযুগ। এর পরে আসে সেন সাম্রাজ্য


২. মধ্যযুগ: সুলতানি ও মুঘল আমল (১২০০ – ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দ)

  • মুসলিম শাসনের আগমন: ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি মুসলিম শাসনের ভিত্তি স্থাপন করেন।

  • স্বাধীন সুলতানি আমল (১৩৩৮-১৫৭৬ খ্রি.): ইলিয়াস শাহী ও হুসেন শাহী রাজবংশের অধীনে বাংলা অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করে এবং একটি একক রাজনৈতিক সত্তা হিসেবে পরিচিতি পায়।

  • মুঘল আমল (১৫৭৬-১৭৫৭ খ্রি.): মুঘলদের কাছে বাংলা ছিল 'দেশের স্বর্গ' (Paradise of Nations)। ১৬১০ সালে ঢাকা (জাহাঙ্গীরনগর) বাংলার রাজধানী হয়।


৩. ঔপনিবেশিক শাসন (১৭৫৭ – ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ)

  • পলাশীর যুদ্ধ (১৭৫৭): ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজিত করে ক্ষমতা দখল করে।

  • শোষণ: ব্রিটিশ শাসনের শুরুতে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর (১৭৭০) হয়।

  • স্বাধীনতা আন্দোলন: ২০শ শতকের শুরুতে বঙ্গভঙ্গ (১৯০৫) কেন্দ্র করে তীব্র জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু হয়।


৪. পাকিস্তান আমল ও স্বাধিকার সংগ্রাম (১৯৪৭ – ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দ)

  • দেশভাগ (১৯৪৭): পূর্ব বাংলা (পূর্ব পাকিস্তান) পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়।

  • ভাষা আন্দোলন (১৯৫২): বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রধান ভিত্তি তৈরি হয়।

  • ৬-দফা আন্দোলন (১৯৬৬): বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন, যা বাঙালির স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতার সনদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।

  • সাধারণ নির্বাচন (১৯৭০): আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করলেও সামরিক জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকার করে।


৫. মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা (১৯৭১ খ্রিস্টাব্দ)

৭ই মার্চের ভাষণ ও গণহত্যার সূচনা

  • ৭ই মার্চের ভাষণ: বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে জাতিকে স্বাধীনতা ও সশস্ত্র যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হওয়ার চূড়ান্ত বার্তা দেন: "এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।"

  • ২৫শে মার্চের গণহত্যা: ২৫শে মার্চ গভীর রাতে পাকিস্তানি বাহিনী 'অপারেশন সার্চলাইট' নামে গণহত্যা শুরু করে এবং বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে।

স্বাধীনতার ঘোষণা: বিতর্ক ও ঐতিহাসিক সত্যের আলোচনা

স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে ঐতিহাসিক ও আইনি নথিপত্র এবং পারিবারিক স্মৃতিকথার ভিত্তিতে আলোচনা নিম্নরূপ:

বিষয়ঐতিহাসিক ও আইনি ভিত্তিবিতর্কিত পারিবারিক সূত্র (তাজউদ্দীন আহমদের সন্তানদের বক্তব্য)
মূল ঘোষকবঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে ওয়ারলেস বার্তার মাধ্যমে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। মুজিবনগর সরকারের ঘোষণাপত্রে এই আইনগত স্বীকৃতি দেওয়া হয়।শারমিন আহমদ ও সোহেল তাজ: তাঁদের লেখায় উল্লেখ করেন, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণায় সই করতে আগ্রহী হননি এবং তিনি লাপাত্তা ছিলেন।
ঘোষণার প্রচারবঙ্গবন্ধুর ঘোষণার ভিত্তিতেই আওয়ামী লীগ নেতা ও পরবর্তীতে মেজর জিয়াউর রহমান ২৭শে মার্চ 'বঙ্গবন্ধুর পক্ষে' ঘোষণাটি পাঠ করেন।সোহেল তাজ: ৭ মার্চের ভাষণ স্বাধীনতার ডাক ছিল না, এটি ছিল উদ্দীপনা।
পর্যবেক্ষণআইনি ও আন্তর্জাতিক দলিল অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু মূল ঘোষক। তাজউদ্দীন আহমদের সন্তানদের বক্তব্য মূলত তাজউদ্দীন আহমদের চরম হতাশা ও একক উদ্যোগে নেতৃত্ব গ্রহণের পরিস্থিতিকে তুলে ধরে।

জাতীয় চার নেতার অবদান ও ট্র্যাজেডি

  • অস্থায়ী সরকার: চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে তাজউদ্দীন আহমদের দূরদর্শী নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়। সৈয়দ নজরুল ইসলাম (ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি), তাজউদ্দীন আহমদ (প্রধানমন্ত্রী), ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী (অর্থ ও শিল্প মন্ত্রী) এবং এ.এইচ.এম. কামারুজ্জামান (স্বরাষ্ট্র ও ত্রাণ মন্ত্রী) নেতৃত্ব দেন।

  • বিজয়: ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়।


৬. স্বাধীন বাংলাদেশ: সংসদীয় গণতন্ত্রের যাত্রা ও চ্যালেঞ্জ (১৯৭২ – বর্তমান)

প্রাথমিক বছরের চ্যালেঞ্জ (১৯৭২-১৯৭৫)

  • রক্ষীবাহিনী গঠন ও নিপীড়ন: ১৯৭২ সালে জাতীয় রক্ষীবাহিনী (JRB) গঠিত হয়। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার উদ্দেশ্যে গঠিত হলেও, এর বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুমের অভিযোগ ওঠে। বিশেষ করে জাসদ (জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল)-এর কর্মীদের উপর কঠোর দমন-পীড়ন চালানো হয়।

  • দুর্নীতি ও দুর্ভিক্ষ: ১৯৭৪ সালের বন্যায় এবং অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার কারণে দেশে ব্যাপক দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এবং কিছু ক্ষমতাধর গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও লুণ্ঠনের অভিযোগ ওঠে।

  • জেল হত্যা: ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর, ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ইতিহাস ও সাংবিধানিক পরিবর্তন

বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ১২টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, যা দেশের গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতার পথ দেখিয়েছে:

নির্বাচনসময়কালপ্রধান বৈশিষ্ট্য
১ম-৪র্থ১৯৭৩-১৯৮৮প্রারম্ভিক সংসদীয় গণতন্ত্র, সামরিক শাসন (জিয়া ও এরশাদ) ও বিতর্কিত নির্বাচন।
৫ম-৯ম১৯৯১-২০০৮সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন (১৯৯১); তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি প্রবর্তন ও এর অধীনে নির্বাচন (১৯৯৬, ২০০১, ২০০৮)।
১০ম-১২শ২০১৪-২০২৪প্রধান বিরোধী দলের বর্জন, ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়, নির্বাচন বিতর্কিত এবং গণতন্ত্রের চ্যালেঞ্জ।

সাম্প্রতিক আন্দোলন ও রাজনৈতিক পটপরিবর্তন (২০১৮-২০২৪)

ক. কোটা সংস্কার আন্দোলন

  • ২০১৮ আন্দোলন: সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতির সংস্কারের দাবিতে শুরু হয়।

  • ২০২৪ আন্দোলন (জুলাই গণ-অভ্যুত্থান): উচ্চ আদালতের রায়ের প্রেক্ষিতে পুনরায় কোটা পদ্ধতি চালুর প্রতিবাদে 'বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন' শুরু হয়। এই আন্দোলন দ্রুতই ছাত্র-জনতার অংশগ্রহণে একটি 'এক দফা' আন্দোলনে রূপ নেয়, যার মূল দাবি ছিল কোটা ব্যবস্থার স্থায়ী বিলুপ্তি এবং সরকারের পদত্যাগ।

খ. ৫ই আগস্টের ঘটনা (২০২৪)

  • কোটা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় দেশব্যাপী তীব্র ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ ও নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।

  • ৫ই আগস্ট ২০২৪ সন্ধ্যায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ত্যাগ করেন। এই ঘটনাটি বাংলাদেশে একটি নজিরবিহীন ও তাৎপর্যপূর্ণ রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটায়।

  • রাষ্ট্রপতি সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করেন এবং ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। এই সরকার দ্রুততম সময়ে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে কাজ করছে।

বর্তমানে বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত এবং দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে গণতান্ত্রিক ধারাকে আরও শক্তিশালী করার দিকে মনোযোগ দিচ্ছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ