আজ ১৭ নভেম্বর, ২০২৫, সোমবার সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে 'জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের' সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় ঘোষণা করা হচ্ছে। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, যা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
বিচারিক প্যানেল ও সময়সূচি
- বিচারিক প্যানেল: আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদার-এর নেতৃত্বে তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল এই রায় ঘোষণা করবেন। অন্য দুই সদস্য হলেন— বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ এবং বিচারপতি মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
- রায় ঘোষণার সময়: জানা গেছে, আজ বেলা ১১টার পর ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম শুরু হবে এবং রায় ঘোষণা করা হবে।
- প্রচার ব্যবস্থা: এই ঐতিহাসিক রায় কার্যক্রমের গুরুত্ব বিবেচনা করে বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম রয়টার্স সরাসরি সম্প্রচার করছে। এছাড়া, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ঢাকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বড় পর্দায় প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
মামলার মূল অভিযোগসমূহ
২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে এই মামলাটি দায়ের করা হয়। প্রসিকিউশন (রাষ্ট্রপক্ষ) তিন আসামির বিরুদ্ধে মোট পাঁচটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এনেছে। এগুলো হলো:
- উসকানিমূলক বক্তব্য: গত বছরের ১৪ জুলাই গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্য প্রদান।
- মারণাস্ত্র ব্যবহার: হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের নির্মূল করার নির্দেশ প্রদান।
- আবু সাঈদ হত্যা: রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যা।
- চানখাঁরপুলে হত্যা: রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় ছয় আন্দোলনকারীকে গুলি করে হত্যা।
- আশুলিয়ায় লাশ পোড়ানো: আশুলিয়ায় ছয়জনকে পুড়িয়ে মারার অভিযোগ।
বিচারকার্য প্রসিডিউর (Procedural Overview)
এই মামলার বিচারকার্য একটি সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হয়েছে:
- মামলা ও গ্রেপ্তারী পরোয়ানা: ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে প্রথম মামলাটি (মিসকেস বা বিবিধ মামলা) হয় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। গত বছরের ১৭ অক্টোবর শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়।
- আসামি তালিকা: প্রথমে শেখ হাসিনাই একমাত্র আসামি ছিলেন। পরে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকেও আসামি করা হয়।
- তদন্ত প্রতিবেদন: ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা চলতি বছরের ১২ মে মোট ৮ হাজার ৭৪৭ পৃষ্ঠার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (Formal Charge) সংবলিত প্রতিবেদন জমা দেয়।
- আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন: গত ১০ জুলাই তিন আসামির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ গঠন করা হয় এবং বিচার শুরু করার আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।
- সাক্ষ্যগ্রহণ (Examination of Witnesses): এই মামলায় মোট ৮৪ জন সাক্ষীর মধ্যে ৫৪ জন সাক্ষী আদালতে জবানবন্দি দেন। সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয় গত ৮ অক্টোবর।
- রাজসাক্ষী: আসামি সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে 'অ্যাপ্রুভার' (রাজসাক্ষী) হওয়ার আবেদন করেন। রাজসাক্ষী হিসেবে তার জবানবন্দি গ্রহণের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে বিচার শুরু হয়।
- যুক্তিতর্ক (Closing Arguments): গত ১২ অক্টোবর যুক্তিতর্ক শুরু হয় এবং ২৩ অক্টোবর অ্যাটর্নি জেনারেলের সমাপনী বক্তব্য ও প্রসিকিউশন-ডিফেন্সের যুক্তিখণ্ডনসহ তা শেষ হয়।
- রায় ঘোষণার তারিখ নির্ধারণ: যুক্তিতর্ক শেষে ১৩ নভেম্বর ট্রাইব্যুনাল আজ, ১৭ নভেম্বর, রায় ঘোষণার দিন ধার্য করেন।
সম্পূর্ণ রায় ও প্রমাণের বিশ্লেষণ পড়ুন: [এখানে ক্লিক করুন]
বিচারের দালিলিক প্রমাণ (Proof and Evidence)
মামলার আনুষ্ঠানিক অভিযোগের বিশালতায় বিচারের প্রমাণের গভীরতা ফুটে উঠেছে:
- পৃষ্ঠাসংখ্যা: আনুষ্ঠানিক অভিযোগের মোট পৃষ্ঠা ছিল ৮ হাজার ৭৪৭।
- দালিলিক প্রমাণ: এর মধ্যে ২ হাজার ১৮ পৃষ্ঠার তথ্যসূত্র এবং ৪ হাজার পাঁচ পৃষ্ঠার জব্দতালিকা ও দালিলিক প্রমাণাদি অন্তর্ভুক্ত ছিল।
- শহীদ তালিকা: শহীদদের তালিকার বিবরণ ছিল ২ হাজার ৭২৪ পৃষ্ঠার।
- প্রসিকিউশনের দাবি: প্রসিকিউশন পক্ষ যুক্তিতর্কে দাবি করেছে, আসামিদের বিরুদ্ধে আনা পাঁচটি অভিযোগই সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করা সম্ভব হয়েছে। তারা শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের সর্বোচ্চ সাজা (মৃত্যুদণ্ড) দাবি করেছেন।
নিরাপত্তা ও তাৎপর্য
রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এবং সুপ্রিম কোর্ট এলাকায় কঠোর বহু-স্তরীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। এ রায় শুধু বাংলাদেশের জন্যই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে। প্রসিকিউশনের আইনজীবীরা বলছেন, এই বিচার হলো 'প্রকৃতির বিচার', যেখানে একজন নেতা নিজের হাতে প্রতিষ্ঠিত ট্রাইব্যুনালেই মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে বিচারের মুখোমুখি হলেন।
0 মন্তব্যসমূহ