আজ, সোমবার (১৭ নভেম্বর, ২০২৫), বাংলাদেশের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী অধ্যায়ের সূচনা হলো। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।
গণ-অভ্যুত্থান সংশ্লিষ্ট মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় এটিই প্রথম মামলার রায়, যা প্রায় ছয় মাস ধরে চলা বিচারিক প্রক্রিয়ার সমাপ্তি টানলো।
ট্রাইব্যুনালের রায় ও সাজার বিবরণ
বিচারিক প্যানেল: ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদার-এর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের প্যানেল এই রায় ঘোষণা করেন।
রায়ের প্রকাশ: দুপুর ১২টা ৪০ মিনিটের দিকে ৪৫০ পৃষ্ঠারও বেশি দীর্ঘ এই রায়ের প্রথম অংশ পড়া শুরু হয়।
শেখ হাসিনার সাজা: আদালতে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আনা পাঁচটি অভিযোগের মধ্যে তিনটি প্রমাণিত হয়েছে। এর মধ্যে একটি অভিযোগে আমৃত্যু কারাদণ্ড এবং অন্য দুটি গুরুতর অপরাধে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়েছে।
দোষী সাব্যস্ত আসামিদের সাজা
| আসামি | পদবি | সাজার বিবরণ | ভূমিকা |
| শেখ হাসিনা | সাবেক প্রধানমন্ত্রী | মৃত্যুদণ্ড (দুটি অভিযোগে) ও আমৃত্যু কারাদণ্ড (একটি অভিযোগে) | মানবতাবিরোধী সব অপরাধের মাস্টারমাইন্ড, পরিকল্পনাকারী, হুকুমদাতা ও সুপিরিয়র কমান্ডার। |
| আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল | সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী | মৃত্যুদণ্ড | মানবতাবিরোধী অপরাধে সরাসরি সম্পৃক্ততা ও নির্দেশদাতা। |
| চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন | সাবেক আইজিপি | ৫ বছরের কারাদণ্ড | দোষ স্বীকার করে রাজসাক্ষী হওয়ায় তুলনামূলক লঘু সাজা। |
বিচারকার্যের প্রধান দিকসমূহ
এই মামলাটি পুনর্গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ বিচার কার্যক্রম।
মামলার সূচনা: গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে প্রথম মামলাটি হয়।
গ্রেফতারি পরোয়ানা: গত বছরের ১৭ অক্টোবর শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়।
রাজসাক্ষী: সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন মামলায় 'অ্যাপ্রুভার' বা রাজসাক্ষী হিসেবে দোষ স্বীকার করে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান কামালের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন।
আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন: ১০ জুলাই তিন আসামির বিরুদ্ধে পাঁচটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে বিচার শুরুর নির্দেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল।
যে পাঁচটি অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে:
জুলাই গণ-অভ্যুত্থান চলাকালীন উসকানিমূলক বক্তব্য প্রদান।
আন্দোলনকারীদের 'হত্যা করে নির্মূলের নির্দেশ' দিতে হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার।
রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ হত্যার ঘটনায় প্ররোচনা, ষড়যন্ত্র, ও সহায়তা।
গত ৫ আগস্ট রাজধানীর চাঁনখারপুল এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দ্বারা ছয়জনকে গুলি করে হত্যার অভিযোগ।
আশুলিয়ায় জীবিত একজনকেসহ মোট ছয়জনকে পুড়িয়ে হত্যার অভিযোগ।
প্রমাণের ভিত্তি ও যুক্তি-তর্ক
সাক্ষ্য: আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী, প্রত্যক্ষদর্শী, আহতদের চিকিৎসা দানকারী চিকিৎসকসহ মোট ৫৪ জন সাক্ষী আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন।
প্রমাণাদি: শেখ হাসিনার কথোপকথনের অডিও, ভিডিও ফুটেজ, গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন এবং জব্দ করা গুলি ট্রাইব্যুনালে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।
রাষ্ট্রপক্ষের দাবি: চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম এবং অ্যাটর্নি জেনারেল উভয়েই যুক্তি-তর্কে দাবি করেন যে শেখ হাসিনা ছিলেন সব অপরাধের 'মাস্টারমাইন্ড' এবং তারা দুই প্রধান আসামির সর্বোচ্চ সাজা অর্থাৎ মৃত্যুদণ্ড দাবি করেন।
এই রায়টি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও বিচারিক ইতিহাসে এক নতুন দিক উন্মোচন করলো।
0 মন্তব্যসমূহ